হাসি রাশি রাশি
এগুলি সব হচ্ছে হাসির বিভিন্ন শব্দে বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু হাসির যদি রকম খুঁজতে বসি, তাহলে কিন্তু রাত কেটে যাবে। যদিও অনেকগুলি আমাদের জানা, তবু লিখতে বা বলতে বসলে খুঁজে খুঁজে নারি।
গোঁফের মতো হাসির আমি, হাসির তুমি, হাসি দিয়ে যায় চেনা।
প্রত্যেক হাসির বিভিন্ন মানে। অর্থহীন হাসিও আছে, যাকে বলে বোকা বোকা হাসি। যারা শয়তান, ঠোঁটের ফাঁক-ফোঁকরে একধরনের ত্রুর হাসি ঝুলিয়ে রাখে, দেখেই মনে হয় প্যাঁচ কষছে। বুদ্ধিজীবীদের আবার চাপা হাসি,মাপা কান্না। সবার থেকে আলাদা থাকতে হবে তো।
চোরের মতো হাসিও আছে, মানে ওই মিচকে শয়তানদের বাঁকা চাঁদের মতো চ্যাংদোলা হাসি। লাফিং ক্লাবে সবাই সশব্দে হাসেন। ওতে নাকি অনেক রোগ নিরাময় হয়। মানে হাস্যচিকিৎসা। তা বিনে পয়সায় ময়দানের হাওয়া খেয়ে, প্রানভরে হেসে যদি দুর্গতি দূর হয় আর দূরে থাকে , ক্ষতি কি?
এরপর আছে পাগলের হাসি। মানে যখন তখন হাসি। এটা হচ্ছে বোকা বোকা হাসির উচ্চাঙ্গ মার্গ। প্রেমে পড়লে এক অদ্ভুত হাসি বেরোয়, অকারণ, অগোছালো হাসি। ওই এলোমেলো, ফুরফুরে মনের মতো। নেতা-নেত্রীদের হাসি আবার বিবিধ - দেঁতো হাসি থেকে শুরু করে দাঁড়ি পাল্লায় মাপা হাসি সব থাকে তাদের বুক পকেটে। " মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক", সঙ্গে দু আউন্স চোখের জলের সাথে তিন মিলিমিটার হাসি ফ্রি।
দেঁতো হাসি হচ্ছে যেখানে দাঁতগুলি সব বের হয়ে থাকে। এটি ভূতেদের আইডেন্টিটি কার্ডের মতো। মিশমিশে কালোর মাঝে সাদা আলোর ঝলকানি, ওই দেখে হিরো থেকে হারকিউলিস সবাই দে ছুট।
রাক্ষসের হাসি আবার আকাশ-বাতাস কাঁপানো। তাতে পৃথিবীর হৃদস্পন্দন থেমে যাওয়ার উপক্রম হয়। ছেঁদো হাসি হলো নকল হাসি, ওর মধ্যে শঠতা থাকে। চওড়া হাসি তাদের পক্ষে হাসা সম্ভব যাদের হা মুখ বড়। যাদের একবারে প্রমান সাইজের ফুচকা মুখে নিতে অসুবিধা হয়, তাদের হাসি এক থেকে দেড় ইঞ্চির মধ্যে সীমাবদ্ধ।
আর একটি আছে ফাজিল হাসি। এটি হচ্ছে মিচকে হাসি আর রকি হাসির একটি ককটেল। ও আচ্ছা রকি হাসি হলো পাড়ার ঠেকে বসে ছোকরারা যেমন খিক খিক করে হাসে। এই রকিদের আর একটি হাসি হচ্ছে খাঁক খাঁক করে হাসি আর তার সঙ্গে ফ্রি তে কিছু অদ্ভুত আওয়াজ এবং/অথবা অশ্রাব্য উক্তি। কটূক্তি বললেও অত্যুক্তি হয় না।
প্রাণখোলা হাসি হচ্ছে যার মধ্যে মলিনতা নেই। একরাশ খুশি উপুড় করা হাসি। ঝেড়ে কাশার মতো, একরকম ঝেড়ে হাসাও আছে। মানে হাসি যেন আসতে চায় না বা তাকে জোর করে চেপে রাখা হয়।
এরপর আছে কাতুকুতু হাসি। এটি সবথেকে ভালো বোঝা যায় পুরোনো দিনের বাংলা সিনেমায় জহর গাঙ্গুলিকে দেখলে।
স্মিত হাসি যা কিনা দেব-দেবীদের ঠোঁটের কোণে হালকা লেগে থাকে, দেখলেই ভালো লাগে, সমীহ জাগে, মন উপুড় করতে ইচ্ছে করে।
এখন কথা হলো, শুধু মানুষ এবং অপদেবতারাই কি হাসে? না। কবি তো বলেই দিয়েছেন, সুনীল আকাশ, শ্যামল কানন,
"বিশদ জোছনা, কুসুম কোমল— সকলই আমার মতো । তারা কেবলই হাসে" । সুতরাং মহাজাগতিক সবকিছুই হাসে। পাহাড় হাসে , জঙ্গল হাসে।
আচ্ছা, মহাপুরুষদের কিন্তু হাসতে খুব একটা দেখা যায় না। শুধু স্বামী বিবেকানন্দের কিছু ছবিতে স্মিতহাস্য মুখ দেখেছি । সারা মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ছড়িয়ে আছে। রবি ঠাকুর? উঁহু, মনে করতে পারি না। অথচ মানুষটি ছিলেন বেশ রসিক। আসলে বিদূষক তো মানুষকে হাসান, নিজে অনেক দুঃখ ভিতরে আগলে রাখেন।
কিছু মানুষের হাসি হচ্ছে তাদের ট্রাম্পকার্ড। ওই যে মহানায়ক। সাধারণ চেহারা, অথচ ওই যে ভুবনভোলানো হাসি। তাতে এখনো মজে আছে
রাই কিশোরী থেকে রসিক খুল্লতাত। ওই রমণীমোহন হাসির কূপে পড়ে কত রমণী যে কাত হয়েছেন তার হিসেব নেই।
হাসির মতো এতো সংক্রামক কোনো কিছু নেই। একটা জায়গায় বেশ কিছু লোক একসাথে বসে হাসছে। এখন যদি আর একজন সেখানে আসে, কিছু জানা, বোঝার আগেই সে হাসতে শুরু করে দেবে।
হাসি শরীরের পক্ষে খুব উপকারী। দিল খুশ, তো সব খুশ। নিজে, বাড়ির লোক, বন্ধুরা, প্রতিবেশী সবার কাছেই তোমার হাসি দারুন টনিক। কিছু মানুষ তো 'হাসমুখ' নামেই পরিচিত হয়ে যান।
তবে সবার কিন্তু হাসির দরকার নেই। এই যেমন "রামগরুড়ের ছানা, হাসতে তাদের মানা।"
এখন কথা উঠতেই পারে হাসি নিয়ে এতো হাসাহাসির দরকার কি? কারণ হলো আজ বিশ্ব হাসি দিবস। অক্টোবরের প্রথম শুক্রবারে এই দিনটি পালিত হয়।
সুতরাং আমরা প্রাণ খুলে হাসি, হাসতে হাসতে পেটে খিল লাগুক, মনের আগল ভাঙুক। আশিতে এসে কাজ নেই, তবে হাসিতে হাসবো না এমন যেন না হয়।
শুভরাত্রি
ঘুম
"কি রে মণি, কটা বাজে খেয়াল আছে? সামনে না তোর পরীক্ষা? এতো বড় হয়ে গেলি, আর কবে বুদ্ধি হবে তোর?"
নমিতা সাতসকালে চিৎকার জুড়ে দেয়। সামনে মেয়ের ICSE পরীক্ষা। কিন্তু মেয়ের তাতে হুঁশ নেই, এদিকে নমিতার বেহুঁশ হবার যোগাড়।
নমিতা কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নার্স। বছর ঘুরলেই প্রমোশন হয়ে মেট্রন হবে। কাজের দায়িত্ব তখন আরো বেশি হবে। নমিতা ভেবে পায় না এতো দিক কি করে সামলাবে। যদিও ঠিকে কাজের লোক আছে ওর। এমনকি রান্নার মাসি এসে সকালের রান্না, বিকেলের রুটিও করে রেখে দিয়ে যান। সেদিকে ও নিশ্চিন্ত। কিন্তু সংসারের কাজ বলতে তো শুধু বাসন মাজা, ঘর মোছা আর রান্নাই শুধু নয় ; অনেক বেশি কিছু। আর সেটুকু গৃহিণীকেই সামলাতে হয়। সবথেকে বড় কথা মেয়েকে তো সময় দিতে হবে। তারপর এই তো মেয়ের পড়ার ছিরি।
নমিতার বর বিবেক ওই একই হাসপাতালে হার্টের ডাক্তার। গালভরা নাম কার্ডিওলজিস্ট। বিবেক সুপুরুষ, উচ্চশিক্ষিত। বেশ কয়েক বছর আমেরিকায় ছিল। ওখানেই এম. ডি. করেছিল। তারপর পাঁচবছর ওখানকার ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকে কাজ করে। শ্বশুরমশাই মারা গেলে দেশে ফিরে আসে। এর দুবছর পরে নমিতার সঙ্গে বিয়ে। সম্মন্ধ করেই বিয়ে, কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে। পড়াশুনায় বিবেকের মতো তুখোড় না হলেও নমিতা কিন্তু ছাত্রী হিসেবে খারাপ ছিল না। তারপর নার্সিং ট্রেনিং শেষ করেই ও ভালো চাকরি পেয়ে গিয়েছিলো।
নমিতা দেখতে খুব সাধারণ। এই নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে তাকে কম কথা শুনতে হয় নি। সেই ট্রাডিশন এখনো চলছে। যেন তাদের রাজপুত্রকে নমিতা বশ করে বিয়েতে রাজি করিয়েছে। প্রথম প্রথম চোখ ফেটে জল আসতো ওর । এখন রাগ হয়, দুচার কথা মাঝে মাঝে নমিতা শুনিয়েও দেয়। শাশুড়ি মা গত হয়েছেন। তবে ননদিনি এখনো রায়বাঘিনী ।
নমিতা আর বিবেকের একমাত্র মেয়ে মণি। ভালো নাম নন্দিনী। ও কলকাতার একটি নামি কনভেন্ট স্কুলে পড়ে। আর মাত্র দুমাস বাকি, এখনো নবাব-নন্দিনী স্বপ্নসুখে বিভোর।
নন্দিনী এর মধ্যে এপাশ ফিরে শুয়েছে। নমিতা এবার খুব রেগে গিয়ে মেয়েকে বেশ ঝাঁকিয়ে দেয়। "এবার যদি না উঠিস, গায়ে জল ঢেলে দেব। রাত দশটাতে শুয়ে সকাল সাতটাতেও ঘুম ভাঙ্গেনা তোমার, ইয়ার্কি পেয়েছো?"
"উফঃ,মা যে কি করেন! কি সুন্দর স্বপ্ন দেখছিলাম", নন্দিনী মনে মনে বলে।
অনেক কষ্টে শরীরটাকে বিছানা থেকে তুলে সে ধীর পায়ে টলতে টলতে বাথরুমে যায়। ব্রাশে টুথপেষ্ট লাগায়। বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত মাজতে থাকে। বলা ভালো ঘষতে থাকে। মায়ের বকবক তখনও শেষ হয়নি। ভাঙা ক্যাসেটের মতো বাজতেই থাকে, প্রতিদিনকার মতো।
কবে যে ও বড় হবে, আর পড়তে হবে না, চাকরি করবে - প্রায়শই একথা ভাবে ও। মানে মায়ের মতো হবে। কথাটা মনে হতেই ও যেন আগুনে ছ্যাঁকা খাওয়ার মতো শিউরে ওঠে। "না, না, কখনো না। মায়ের মতো হতে চাইনা আমি।"
নন্দিনী খুব ধীরজ। চলতি বাংলায় যাকে বলে আঠারো মাসে বছর হয় ওর। খুব ক্ষীণকায় চেহারা। মাঝারি লম্বা। গায়ের রং বেশ ফর্সা । সাদা ফর্সা, দেখলে মনে হয় যেন অ্যানিমিয়ায় ভুগছে । ভীষণ দুর্বল লাগে ওকে। ক্লাস চলাকালীন প্রায়ই ঘুমিয়ে পড়ে।
ক্লাসে ওর সেরকম কোনো বন্ধু নেই। তবে ওর প্রতীক্ষাকে ভীষণ পছন্দ। প্রতীক্ষা খুব কম কথা বলে। সত্যি বলতে কি ও কথাই বলে না। ক্লাস ফাইভ থেকে একসাথে পরছে ওরা। কিন্তু এই ছয় বছরে প্রতীক্ষা কতগুলো কথা বলেছে তা গুনে বলা যায়। চোখ দুটো গভীর আর মুখটা ভীষণ মিষ্টি। বিশেষ করে ওর হাসিটা, হাসলে দুগালেই টোল পরে।
প্রতীক্ষাকেই মনখুলে সবকিছু বলতে পারে নন্দিনী । ও কাউকে বলে দেয় না। প্রথম প্রথম এড়িয়ে চললেও, নন্দিনী বোঝে প্রতীক্ষার ওর প্রতি কেমন যেন একটা মায়া জন্মে গেছে। ওকে যখন কোনো টিচার বকেন বা বন্ধুরা ওকে নিয়ে ঠাট্টা করে, প্রতীক্ষার মায়াভরা মুখে বেদনার ছাপ স্পষ্ট হয়।
নন্দিনী জানে প্রতীক্ষা ওকে বুঝতে পারে। এই যেমন ও কেন ক্লাসে এতো অমনোযোগী বা প্রায়শই কেন ঘুমিয়ে পড়ে । "কি অদ্ভুত! আমার মা বুঝতে পারেন না। আর পারলেই বা কি; তাতে কি আর ওর সমস্যার সমাধান করতে পারবেন? উল্টে ওকে আরো দুচারটে জ্ঞানের কথা শোনাবেন।"
এই তো সেদিন ফিজিক্স টিচার আর্কিমিডিস' ল বোঝাতে বললেন। ও বলেওছে, কিন্তু পুরো ব্যাপারটা সেইভাবে বুঝিয়ে বলতে পারেনি। কি বকুনিটাই না খেলো। চোখ ছলছল। ঘুমিয়ে পড়েছিল মাঝপথে। আর কি? টিচার ধরে আচ্ছা করে দিলেন। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে।
অথচ ওর যে কোনো শারীরিক সমস্যা আছে তাও না। ডাক্তার দেখানো হয়েছে, ডায়েট চার্ট আছে। তার উপর ওর বাবা একজন ডাক্তার। "নাহঃ, রোগটা ওর মনের।" দিদুন বলেছিলেন।
"কিরে প্রেম-টেম করছিস নাকি?", মা জিজ্ঞেস করেছিলেন ।
"দূরঃ, কি যে বলো না?"
অবশ্য প্রেম করলেও থোড়াই না মাকে বলতে আছে ওসব কথা?
প্রেম যে দুয়ারে এসে দাঁড়ায়নি তা বলা যায় না। কেমিস্ট্রির প্রাইভেট টিউশনে দুজন তাকে প্রপোজ করেছে। সার্থক আর অভীক। ও ঠিক করে উঠতে পারে নি কাকে হ্যাঁ বলবে অথবা আদৌ হ্যাঁ বলবে কিনা। প্রতীক্ষাকে জিজ্ঞেস করেছিল এ ব্যাপারে। ওর চোখ তো বিস্ফারিত, আর মৃদু হাসি চাপতে গিয়ে ঠোঁটের কোণ ঈষৎ বক্র হয়ে ওঠা নাম করছিলো ।
অস্থির লাগে ওর। স্কুল ছুটির পরে ঘরে ফিরতে মন চায় না। যদি কোথাও চলে যেতে পারতো। ঘরে ফিরে সে একা। আজকাল নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে এক কাহিনী। তবু কোজাগরীর ঠাকুমা ওদের সঙ্গে থাকেন, সমৃদ্ধির ভাই আছে, ঐশীর দিদা ওদের সঙ্গে থাকেন। এরকম অনেকেরই মা-বাবা দুজনেই চাকরি করেন, কিন্তু তারা ঘরে ফিরে একা হয়ে যায় না।
ওর ঠাকুমা, দাদু দুজনেই মারা গেছেন। তবে দিদা আছেন। উনি সুদূর বর্ধমানে থাকেন। ওর মার খুব ইচ্ছে ওনাকে এখানে এনে রাখবেন । কিন্তু নন্দিনী জানে তা সম্ভব নয়। অথচ ওর দিদা কিন্তু ওর মাসির বাড়িতে বছরের আট মাস থাকেন। বাকি সময়টা দেশের বাড়িতে মামার কাছে কাটে ওনার। শুধু ভাই-ফোঁটার সময় মা যান ওখানে। তখন নন্দিনীও যায়। ওর ভালো লাগে লোকজন, হৈহট্টগোল। মাসীমণি, মামা, মায়িমা, দুটো ছোট ভাই রাজা আর ঋজু। ভারী মজা হয় তখন।
এক পিসি আছেন, মাঝে মাঝেই আসেন এখানে। তবে নমিতা ওর শ্বশুর বাড়ির লোকদের সেরকম পছন্দ করে না। সেজন্যে অবশ্য নন্দিনী মাকে দোষ দেয় না।
ঘরে ফিরে হাত পা ধুয়ে, ড্রেস চেঞ্জ করে, কোনোমতে কিছু খেয়ে ও প্রজেক্টের কাজ করতে বসে যায়। অনেক কাজ। "পরীক্ষার মাঝে এইসব কাজ করলে পড়বে কখন ওরা ?" সেদিন অন্বেষার মা বলছিলেন। সব মায়েদেরই এককথা। নমিতা মেয়েকে সাহায্য করে, নইলে ও একা একা পারবে কি করে?
সেদিন বাংলার প্রজেক্টটা দারুণ হয়েছিল। কিন্তু ক্লাসের বন্ধুরা কেউ বিশ্বাস করতে চাইলো না যে নন্দিনী ওটা নিজে করেছে । এমনকি টিচারদেরও একই কথা। সে কি মুখ টিপে হাসি তাঁদের। ইংলিশ টিচার শ্রীরূপা তো বলেই বসলেন, "তা তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এতো কাজ করে নিলে?". খুব খারাপ লেগেছিলো ওর। চোখ দিয়ে অঝোরে জল গড়াচ্ছিল। ও আড়ালে চোখ মুচ্ছিলো।
প্রতীক্ষা নন্দিনীর কাঁধে হাত রেখেছিলো। যেন বলতে চাইছিলো, "আমি তোকে বিশ্বাস করি।"
মা-বাবার ফিরতে একটু দেরি হলো আজ'। হাত-পা ধুয়ে ফ্রেশ হোয়ে নমিতা কফি করতে গেল । নন্দিনীর জন্যে প্লেটে করে স্ন্যাক্স নিয়ে এলো। একটু বিশ্রাম নিয়ে নন্দিনীর সঙ্গে প্রজেক্টে হাত লাগাবে।
"উফঃ , মা পারেন বটে”, নন্দিনী মনে মনে ভাবে। “হাসপাতালের ডিউটি করে, সংসার সামলিয়ে, ওর লেখাপড়ায় সাহায্য করেন । প্রাইভেট টিউশনে তো বেশির ভাগ দিন মা ওকে দিয়ে আসেন। তার উপর বাবার ফাইফরমাশ। সব কিছু হাতের সামনে গুছিয়ে রাখতে হবে। পান থেকে চুন খসলেই হলো আর কি!"
নন্দিনী মনে মনে ভাবে হাসপাতালেও কি বাবা এরকম চ্যাঁচামেচি করেন নার্স বা অন্যান্য স্টাফদের সঙ্গে?
নন্দিনী ধীর হলেও একাগ্রচিত্ত। আর পড়াশুনার থেকে ওর এসব কাজে আগ্রহ বেশি। ওর আঁকার হাতটিও বেশ চমৎকার। নমিতা মেয়েকে লক্ষ্য করতে থাকে। "সেরকম হলে ও ফ্যাশন ডিজাইনিং, ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন অথবা ফাইন আর্টস নিয়ে পড়াশুনা করুক । সবাইকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে এমন তো কোনো মানে নেই।"
ঘড়ির কাটা ১০ টা ছুঁয়েছে। "নাহ, এবার খাবার যোগাড় করি। তারপর গোছগাছ করে মেয়ের সঙ্গে একটু বসতে হবে।"
খাওয়ার টেবিলে টুকটাক কথা হয়। ওই আর পাঁচটা বাড়িতে যেমন হয় আরকি। বিবেকের সামনে নন্দিনী একটু আড়ষ্ট থাকে। বিবেক যে ওকে ধমকায় তা কিন্তু নয়। তবে দুজনের ভিতর একটা দূরত্ব আছে সেটা বেশ বোঝা যায়।
খাওয়া শেষ হলে, সব কিছু পরিষ্কার করে, নমিতা যখন নন্দিনীর কাছে এলো তখন ১১টা বেজে গেছে।
মা-মেয়ে মিলে এবার কাজ করবে। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটেও নমিতা এই সময়টা সেরকম ক্লান্ত বোধ করে না। মেয়ের সঙ্গে সময় কাটাতে ওর ভালো লাগে। বেশির ভাগ দিন ওর পড়াশুনা দেখে আর মাঝে মাঝে প্রজেক্টের কাজ। এই করতেই প্রতিদিন ১টা বেজে যায়। মা-মেয়েতে এই সময় কিছু মনের কথাও হয়।
দুজনে যে কতক্ষণ ব্যস্ত ছিল নিজেরাও জানে না। হঠাৎ বিবেকের চিৎকারে ওরা সচকিত হয়।
"কি হল, আমার ফাইলগুলো কোথায়? গাড়ি থেকে নামবার সময় তো তোমার হাতে দিয়েছি। রেখেছো কোথায়?"
"টেবিলের উপরে রেখেছিলাম।"
"তাহলে গেলো কোথায়; হাওয়া হয়ে গেলো?"
"বললাম তো টেবিলের উপর রেখেছি। একটু খুঁজে দেখো, হয়তো তুমিই ভুলে কোথাও সরিয়ে রেখেছো।"
"ওসব জানি না, ফাইল খুঁজে দাও। একটা কাজ যদি ঠিক করে করতে পারো।"
আর কি করা, বাধ্য হয়ে নমিতাকে উঠতে হয়।
একটু খোঁজাখুঁজির পরেই ফাইলটা পাওয়া গেলো। খাট আর টেবিলের মাঝে আটকে আছে। নমিতা ফাইলটা সাবধানে বের করে আনে, সামান্য একটু দুমড়ে গেছে।
"জানো এটা আমার কত ইম্পরট্যান্ট ফাইল? কাল আমি কি জবাব দেব? এই যে তুমি, মুখের সামনে সং এর মতো দাঁড়িয়ে আছো; এতো কিসের ব্যস্ততা তোমার? সামান্য জিনিস গুছিয়ে রাখতে পারো না। দূর দূর করে ঘর থেকে বের করে দেব।"
কথাটা যে নমিতা নতুন শুনছে তা নয়। এর থেকেও অনেক বেশি কটু কথা সে বিবেকের কাছে শুনতে অভ্যস্ত। কিন্তু আজ অল্পেতেই নমিতার বাঁধ ভাঙ্গে। সকালে ননদের খোঁটায় যে আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছিল, তাতে যেন ঘৃতাহুতি পড়ে।
"হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই দাও। পরিশ্রম শুধু তুমি করো, আমি করি না? আর ভুলে যেও না, বাড়িটা তোমার নামে হতে পারে, কিন্তু মাসগেলে সংসার খরচের জন্য আমিও টাকা দি। খোঁজ রেখেছো কখনো মেয়ের স্কুলে কত খরচ হয়? আজ এটা, কাল সেটা, লেগেই আছে. এসব খরচার জন্যে তোমার কাছে কোনোদিন হাতপেতেছি? সব নিজেই করি। প্রাইভেট টিউশনের খরচও আমার। এত বড় বড় কথা শুনিও না।"
নন্দিনীর কানে আসে ঠাস করে একটা জোরে শব্দ আর তার সঙ্গে অশ্রাব্য কিছু বাক্যবাণ। আর সেই সঙ্গে চেয়ারের উপর একজনের পড়ে যাওয়ার আওয়াজ। নন্দিনী উঠে ওঘরে যাবার চেষ্টা করে। কিন্তু ওর পাদুটো যেন কেউ সজোরে বেঁধে রেখে দিয়েছে। চোখে গরম বাষ্প ঠেলে বেরোতে চাইছে । বুকে বহ্নিশিখা।
স্থাণুর মতো বসে থাকে কিছুক্ষণ। গালের উপর জলের দাগ শুকিয়ে গেছে, শরীরটা ঠান্ডা হয়ে এসেছে যেন। ভীষণ ঘুম পাচ্ছে ওর, চোখ খুলে রাখা দায়।
নমিতা হুমড়ি খেয়ে চেয়ারের উপর পড়েছিল। নিজেকে সামলে নিয়ে ওখানেই বসে থাকে । ঠোঁটের একপাশ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। শোবার ঘরের দরজা সজোরে বন্ধ করে বিবেক তখন বারান্দায় চলে গেছে। ওখানেই বসে কিছুক্ষণ রঙ্গিন জল খাবে।
নোনতা জলের ধারা নমিতার ঠোঁটের পাতায় এসে জমা হতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কেটে যায়। একটু ধাতস্থ হয়ে আস্তে আস্তে ওঠে। তারপর ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ও। মেয়ের সঙ্গে চোখ মেলাতেও লজ্জা লাগে ওর। অথচ ওর তো কোনো দোষ নেই। আড় চোখে দেখে নন্দিনী খাতা, পেন,পেন্সিল মেঝেতে ছড়িয়ে রেখে বিছানায় শুয়ে পড়েছে।
চোখে-মুখে আস্তে আস্তে জল দেয় ও। ব্যথা করছে ভীষণ। তবে এই ব্যথাটা ওর ভীষণ চেনা। বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই শুরু। তারপর থেকে প্রায় দিন, এর শেষ কবে ওর জানা নেই।
ঘরে এসে ছড়িয়ে থাকা সব কিছু গুছিয়ে তুলে রাখে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে আলতো হাতে ব্যথা জায়গায় ওষুধ দেয়। কালশিটে পড়ে গেছে। একটু চড়া মেকআপ করবে কাল।
টিউবলাইট নিভিয়ে ডিমলাইট জ্বালায় নমিতা। বিছানায় এসে কিছুক্ষণ বসে থাকে। মেয়ের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে ও। নন্দিনী উল্টো দিকে মুখ করে শুয়েছে। নিঃশ্বাস পড়ার শব্দ হচ্ছে । ধীরে ধীরে ওর কাছে এসে শোয়। ওর গায়ে হাত রাখে। ওর মাথায় হাত বোলাতে থাকে।
নন্দিনীর ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু ঘুমোনোর ভান করে পড়ে থাকে ও । বুকের ভিতরটা আবার দলা পাকিয়ে উঠছে। কি বলতে পারে ও মাকে ? প্রতিদিনকার অপমান, নির্যাতনের যে গভীর ক্ষত তাতে প্রলেপ দেবে কি করে? ও শুধু স্বপ্ন দেখে মাকে নিয়ে দূরে, অনেক দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে।
"ঘুমিয়ে পড়লেই কি সব সমস্যা মিটে যায় রে মা? তাদেরকে যে জেগে থেকে মোকাবিলা করতে হয়। নইলে যে সবাই আরো পেয়ে বসে।"
সস্নেহে মেয়ের কপালে চুমু খায় নমিতা।
নন্দিনী অবাক হয়। ওর হৃৎস্পন্দন দ্রুত হতে থাকে। প্রবলভাবে চেষ্টা করতে থাকে মা যেন টের না পান।
মায়ের ব্যথা করছে, কথাগুলো বলতে কষ্ট হচ্ছে, স্পষ্ট বুঝতে পারে নন্দিনী। "মা তাহলে সব জানেন, সব বোঝেন। ওই শুধু ভাবে যে...."
বাইরে হঠাৎ মেঘ গুমরে গুমরে উঠছে। অঝোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। নন্দিনীর মাথার বালিশও বর্ষায় ভিজে গেছে। ও ঘুমাতে চেষ্টা করে শুধু স্বপ্ন দেখবে বলে।
হাত বাড়ালেই বন্ধু........
"এই শোন্, ওর সাথে যদি কথা বলিস, তাহলে তোর সাথে আড়ি। তুই হচ্ছিস আমাদের দলের, ওরা থাকে ওধারে।" মনে পড়ে স্নিগ্ধা?
সেই ছোটবেলা থেকে বন্ধুদের মাঝে বেড়া। সে বেড়া টপকে দিব্যি এদিকে, ওদিকে আসা যাওয়া। ভারী মজার। তারপর একদিন যখন প্রাইমারির গন্ডি পেরিয়ে সেকেন্ডারি তে প্রমোশন হয়, সেদিন আবার সব হাত একসাথে হয়ে কথা দেওয়া "আবার হবে তো দেখা।"
কখনো পথ চলতে কারো সাথে দেখা হয়, লাভাস্রোতের মতো আবেগের উষ্ণ প্রস্রবণ। বড় হবার সাথে সাথে মশলাদার কথাবার্তা, উপকরণ যদিও যৎসামান্য।
মাধ্যমিকের পরে অনেক চেনা মুখের আবার একসাথে একাকার হওয়া। সময় এগিয়ে চলে, কিছু কিছু চেনা মুখ, হারিয়ে যাওয়া ছন্দ ফিরে ফিরে আসে, জিয়া নস্টাল হয়, চোখের পাড়ে মিঠে কুয়াশা জমা হয়।
অনেকদিন পরে সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে আবার কালো কালো মাথা গুলো ভিড় করে। বিশাল পরিবার। কিন্তু হায় রে সময়! ভিড় পাতলা হয়েছে কিছুটা।
অনুপম তো কবেই পলাতক, তখন আমরা ক্লাস ইলেভেন। তারপর পালা করে রাজা, নিয়োগী, বিউটি আর সবশেষে ইলা। গতবার আমার জন্মদিনে সুপর্ণা বললো ওর প্রেসার নাকি অনেকটাই বেশি থাকে। আরো বেশি হলে নাকি ভোকাট্টা। টুম্পা, ওপাশে যাওয়ার তাড়া আছে নাকি?
শবরীকে ফোন না করলে ও আমার সাথে কাট্টি করবে বলে। ধেৎ, বন্ধুত্বে আবার ভাবের অভাব হয় নাকি?
WA তে একরাশ প্ল্যান, কবে কোথায় আবার হবে দেখা। অনাবিল আনন্দের, অনর্গল বকবক আর রামধনু উচ্ছাসের এক অদ্ভুত ককটেল। নেশা হয়, বেশ লাগে। আনন্দ ঘন হয়, ভাবতে ভালো লাগে আছি কাছাকাছি, পাশাপাশি।
" জায়গা রাখা আছে।" সেই ছোটবেলায় ছোট্ট ক্লাসরুমের কুঠুরি থেকে বাস, ট্রাম, ট্রেনে - জায়গা রাখাই থাকা বন্ধুদের জন্যে। তারপর একদিন হাত ছাড়িয়ে যেতে যেতে বলে যাওয়া, "অপেক্ষা করবো তারাদের দেশে, সেখানেও জায়গা রাখা আছে।"
ভীষণ মনখারাপের দিনে হাতের পরশ রইবে হাতে। দুফোঁটা আবেগ যেন পদ্মপত্রে নীড়। অথবা ফোন করে বলা, থাকনা ছুঁয়ে একটু আমায় আজ, হোক না আজ তিস্তা খরস্রোতা।
ভালো থাকিস সবাই.......