ঋতুদাকে
প্রিয় চোখের বালি,
এই প্রথম তোমাকে চিঠি লিখছি। তোমাকে এই নামে যেদিন প্রথম ডেকেছিলাম সেদিনটা আজও মনে আছে - ১৯শে এপ্রিল। তুমিতো চলে গেলে, তারপর বাড়ির সবাই আমাকে সেকি বকাবকি। "ও কি মেয়ে নাকি যে ওই নাম ওকে ডাকবি? ও তো সই কে ডাকে।" আমি ঠিক করে নিয়েছিলাম তোমাকে একান্তে ওই নামেই ডাকবো।
প্রথম আলাপের কিছুদিন পরে তুমি আমাকে তোমার ভীষণ প্রিয় হীরের আংটি দেখিয়েছিলে। কি যে ভালো লেগেছিলো। তুমি কি করে যেন আমার মনের সব কথা সব জেনে ফেলতে । শুধু কি আমার? সবার। ওই যে ওই মেয়েটি গো। কি যেন নাম? ওহ, মনে পড়েছে। তাহার নামটি রঞ্জনা। মনে মনে একটু দুঃখ পেতাম বৈকি। তুমি না শুধু আমার দোসর, অন্যের সাথে তোমার কেন ভাব হবে? তুমি সব বুঝতে। আমার অন্তরমহল তোমার কাছে ছিল খোলা পাতা।
একদিন তোমায় খুব সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিলাম। "সত্যি বলতো তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো?" "তুই আমার অনেকখানি, বাকি সব চরিত্র কাল্পনিক। ওরা আছে বলে বুঝি তুই আমার কত কাছের।" আমি তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম, এখনো করি। আমি জানতাম আমাদের সম্পর্কের রসায়নটা একটু অন্যরকম প্রেমের গল্প।
তুমি আর আমি দুজনেই রবীন্দ্রনাথ আর সত্যজিতের ভক্ত। কিছু মিল ছিল বলেই একসুতোয় বাঁধা পড়েছিলাম। তুমি তোমার জীবন স্মৃতি থেকে গল্প শোনাতে। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। তোমাকে বলি বলি করেও বলা হয়নি - তোমাকে তখন দ্য লাষ্ট লিয়ার- এর মতো লাগতো।
মনে আছে একবার কি ভয়ানক অসুখে পড়েছিলাম। তুমি প্রতিদিন আসতে আমার কাছে। একঝাঁক গল্প। আর সাথে একঝিল ভালোবাসা। কম বললাম কি? হয়তো তাই। তুমি আমাকে মেমোরিজ ইন মার্চ এর কাহিনী শুনিয়েছিলে। বাবাঃ। তুমি যে মেয়েদের মনের খবর জেনে ফেলো সেটা তো জানাছিল। সেদিন জানলাম, তুমি সত্যান্বেষী। ব্যোমকেশ বকশির সাথে দেখা হয়েছিল গো তোমার?
আমার শরীর তখনো দুর্বল। এদিকে সামনে উৎসব। দুর্গাপূজা। তুমি আমার বাড়িওয়ালীকে রাজি করিয়ে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলে ঠাকুর দেখাবে বলে। তখনকি জানতাম তুমি এর পরের বছর ছুটি নিয়ে চলে যাবে। তোমার চোখে-মুখে বাচ্চাদের ঔৎসুক্য, অনাবিল আনন্দ।
তোমাকে সেদিন কি এমন বলেছিলাম যে এতো রেগে গিয়েছিলে। আবহমান কাল থেকে বৃহন্নলাদের অস্তিত্ব তো মেনে নেওয়া হয়েছে। তুমি তো চিত্রাঙ্গদা। মনটা কি সব নয়? কাঁটাছেড়ার কি দরকার? তুমি অভিমান করেছিলে। ঠোঁট ফুলিয়ে বলেছিলে, আমি মনে যা, শরীরেও তা হতে চাই।
তুমি আমাকে ভুল বুঝেছিলে। কি করে? তুমি তো মেয়েদের মন পড়তে পারতে। তাহলে ছদ্ম অভিনয় করেছিলে? মাঝে মাঝে ভাবতাম তিতলি হয়ে উড়ে গিয়ে তোমাকে দেখে আসি। কিন্তু যাই নি। আমার বুঝি রাগ করতে নেই। ঠিক করেছিলাম এক শুভ মহরত দেখে যাব তোমার কাছে। কিন্তু হলো কই। তার আগেই যে আমার সাধের নৌকাডুবি হলো। সব স্মৃতি রয়ে গেলো, মাঝি শুধু গেলো চলে।
সেদিন বৃষ্টি নেমেছিল। ওরা গিয়েছিলো সব রেইনকোট পরে। শেষ দেখা দেখতেও আমি যাইনি। তোমাকে ওভাবে দেখতে চাইনি আমি। কেন আগে যাইনি তোমার কাছে? তীব্র দহনে ভিতর পুড়ছিল। বেশ বুঝতে পেরেছিলাম আমার খেলা ঘর বাঁধ ভেঙেছে । ঠোঁটের পাতায় শ্রাবণ জমেছিলো। বিড়বিড় করে শুধু বলছিলাম, "প্লিজ কাম ব্যাক" ।
একবার জন্মদিনে সানগ্লাস উপহার দিয়েছিলে। বলেছিলে, এটা শুধু সূর্য্যের আলো থেকে বাঁচতে নয়, যেদিন খুব কান্না পাবে সেদিনও পরে থাকবি। তুমি কি জানতে সেদিন কান্নাটাই সম্বল করে আমাকে বেঁচে থাকতে হবে?
তারপর তো কেটে গেলো কতগুলো বছর। ঝিরিঝিরি বর্ষায় সারা বছর ভিজি, বসন্ত আসে কোই? প্রতিবছর এই দিনটিতে নিয়ম করে আমরা ঋতুমতী হই। আমরা সবাই - পুরুষ, নারী, এমনকি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরাও। সেটা বোধহয় তুমি ঋতুরাজ বলেই।
ভালো থেকো ঋতুদা,গানের ওপারে চিরদিন, চিরপ্রবাসে।
ইতি
মৃণালিনী
আমরা ও ওরা
"মা আমি কোথা থেকে এলাম?"
এটা বাচ্চাদের খুব কমন প্রশ্ন।
ঈষৎ ঢোক গিলে মায়েদের উত্তর, "তোমাকে ভগবান পাঠিয়েছেন, সোনা।"
খুব একটা ভুল নেই, কারণ আমরা সবাই "ঈশ্বর কণা" .
এখন উত্তরটা যদি এইরকম হয়, "আমরা সবাই জানোয়ারের দল, মানে আমরা জানোয়ার থেকে এসেছি"?
সেটাও অন্যদিক দিয়ে ঠিক, কারণ বিবর্তনের শেষ ধাপে মানুষ।
মুশকিল অন্যজায়গায়। নিজেকে জানোয়ারের মতো বলা মানে নিজেকেই গালমন্দ করা। অন্যকে গালি দেবার সময় এই দু দশক আগে পর্যন্তও "শুওরের বা......" কথাটির বহুল প্রচলন ছিল। এখন আমরা গতিশীল জীব, সুতরাং এতো কমে মন ভরে না।
অথচ, আমাদের মধ্যে কিন্তু জানোয়ারদের অনেক গুন আছে। যেমন, আমাদের নেতারা যেমন বাচ্চাদের কোলে তুলে নেন, বিশেষ করে ভোটের আগে বা যেকোনো সময় ক্যামেরায় pose দেবার জন্যে, এই স্বভাব কিন্তু গোরিলাদের মধ্যে ভীষণ ভাবে বর্তমান। আবার ওদের মধ্যে নেতাদের পা হিঁচড়ে সাংঘাতিক হিংস্র উপায়ে মেরে ফেলার ঘটানো ঘটে। আমরা আমাদের রাজীনীতিতেও কি এরকমটাই লক্ষ্য করি না?
Macaque (মূলতঃ, জঙ্গলে বসবাসকারী বানর) দের মধ্যে একটি ভয়ঙ্কর ব্যাপার আছে আর তা হলো ধর্ষণ। পুরুষ macaque তার কন্যা সন্তানদের ধর্ষণ করে। এমনকি কখনো কখনো দুধের শিশুকে মায়ের কোল থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এসে তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে।
বহু মানুষের মধ্যে শৃগালের চরিত্র বর্তমান। অর্থাৎ তারা ধূর্ত।"এই, কুকুরের মতো পায়ের কাছে ঘুরঘুর করিস না। " খুব শোনা কথা। অর্থাৎ কেউ যদি চটিচাটা হয় , তাদের ক্ষেত্রে এই কথাটি বহুল ব্যবহৃত। তবে কুকুর কিন্তু কিছু পাওয়ার আশায় ঘুরঘুর করে না। সে প্রভুভক্ত, ওই অনেকটা রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের মতো। কিছু বোঝার দরকার নেই, স্লোগানের লেজটি জোর গলায় বললেই হলো, ভক্তি যেন টইটম্বুর হয়, টলমল করলে চলবে না।
বিড়ালের বাপ্যার আলাদা। বাঘের মাসি বলে তার মর্যাদা অনেক উঁচু তারে বাঁধা। বিড়াল যে বাড়িতেই থাকুক না কেন, সে তার নিজ মর্জির মালিক। সে অনায়াসে মালিকের চোখের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকাতে পারে, যেন বলছে, "You're sitting in my seat."
Tiger is always royal . ওর চোখ বলে দেবে, "don't try to mess with me." . "বাঘের বাচ্চা" এই কথাটির মধ্যে বেশ গৌরব আছে। মানে যাকে বলা হলো, সে যথেষ্ট রাশভারী এবং সাহসী।
সিংহ হচ্ছে 'হারামি' মানে সে কক্ষনো one-woman man নয়। ও পলিগ্যামিতে বিশ্বাস করে। ওর দশ-বারো নারী না হলে চলে না, মানে সোজা কথায় হারেম চাই। প্রসঙ্গতঃ, সিংহ নয়, সিংহী কিন্তু territory রক্ষা করে।
সুতরাং, এখন থেকে কাউকে "জানোয়ারের বাচ্চা", বিশেষ করে "শুওরের বা..." কথাটি না বলাই ভালো। কে জানে, ওরাও হয়তো ছেলেমেয়েদের এই বলে শাসন করে যে, "রেখেছ মানুষ করেমানুষ করে, জানোয়ার করো নি"!
বাবা মা তো, সন্তানের ভালো-মন্দ এরকম করে আর কেই বা ভাবে?
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
অরিন্দম মুখার্জী (The author of Journey Dog Tales)
সৌরভ চক্রবর্তী (ফটোগ্রাফার)